ইন্টারনেট এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
(ইনডেপথ)

ল ওটলেট (১৮৬৮-১৯৪৪) ছিলেন বেলজিয়ান লেখক, উদ্যোক্তা, আইনজীবী ও শান্তিকর্মী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই তিনি ইন্টারনেট সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। যাকে তিনি 'ডকুমেন্টেশন' বলে অভিহিত করেছিলেন। 

তিনি এরও অনেক আগে ১৮৯৫ সালে অঁরি লা ফোঁতেন এর উদ্যোগে শুরু হওয়া একটি প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে তথ্য সংগঠিতকরণ ও সহজলভ্য করার লক্ষ্যে "মুন্ডেনিয়াম" নামে অভিনব প্রকল্প চালু করেছিলেন। 

তিনি চেয়েছিলেন সেই সময়ের প্রযুক্তি—টেলিফোন এবং রেডিও—ব্যবহার করে ইন্টারনেটের মত কিছু তৈরি করবে এই মুন্ডেনিয়াম।

তাকে তথ্যবিজ্ঞানের জনক ও ইন্টারনেটের পূর্বসূরীদের একজন বিবেচনা করা হয়।

তবে সত্যিকারের ইন্টারনেট এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘প্যাকেট সুইচিং প্রযুক্তি’ গবেষণার মাধ্যমে। ১৯৬৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের অর্থায়নে তৈরি করা হয়েছিল ARPANET নেটওয়ার্ক। এটিই ছিল ইন্টারনেট এর বর্তমান রূপের ভিত্তি। এরপর ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় ARPANET-এর সাথে যুক্ত হতে থাকে। 

তবে ARPANET কেন শুরু হয়েছিল তা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। 

ইন্টারনেট এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস


# ইন্টারনেট এর সূচনা

কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধের চরম পর্যায় তখন। উত্তর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলছে চূড়ান্ত মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। দুই সুপার পাওয়ার রাষ্ট্রেরই মজুদ আছে ভয়ঙ্কর পরমাণু মারণাস্ত্র। সাধারণ মানুষের মনে চাপা ভয়, এই বুঝি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ শুরু হয়ে যায়!

সে সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার বুঝতে পারে, তাদের এমন একটা যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রয়োজন যা যেকোনো পরিস্থিতিতে সোভিয়েত বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের হাত থেকে নিরাপদ থাকবে।

তখনকার কম্পিউটারগুলি ছিল দামি ও আকারে বিশাল। সামরিক বাহিনীর বিজ্ঞানী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকজনই কেবল এগুলি ব্যবহার করতে পারত। এই মেশিনগুলি অনেক শক্তিশালী হলেও সংখ্যায় তখন ছিল মাত্র গুটিকয়। সে কারণে গবেষকদের বিড়ম্বনায় পড়তে হত। দেখা যেত শুধু কম্পিউটার ব্যবহার করতে হবে তাই হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে দূর-দূরান্তে যেতে হচ্ছে।

ডিভাইস স্বল্পতার সমস্যা কাটাতে গবেষকরা তখন ‘টাইম শেয়ারিং’ শুরু করলেন। এই ব্যবস্থায় ব্যবহারকারীরা একই সাথে অনেকগুলি টার্মিনালের মাধ্যমে মেইনফ্রেম কম্পিউটারে ঢুকতে পারতেন। আগে একক ভাবে টার্মিনালে কাজ করার সময় মূল কম্পিউটারের যে শক্তি তার খুব অল্পই ব্যবহার করা যেত।

এসব জটিলতা ও বাধার কারণে অনেক বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ ও প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা বড় আকারের কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন।

.

# রিসার্চ প্রজেক্ট ARPA

আমেরিকার আরপানেট প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সোভিয়েত কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১ এর যোগ আছে। 

স্পুটনিক-১ ছিল পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর এটি উৎক্ষেপণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সে ঘটনা বিশ্বব্যাপী তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে। মহাকাশ প্রতিযোগিতায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের। 

যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল স্পুটনিক-১ ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, শত্রুপক্ষের সাফল্য দেখে যুক্তরাষ্টকে যেন আর বিস্মিত হতে না হয়!

পরের বছর, ১৯৫৮ সালে, প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের সেরা বিজ্ঞান প্রতিভাদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি বা ARPA। 

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রযুক্তি যেন সবসময় শত্রুপক্ষের চাইতে এগিয়ে থাকতে পারে, সেটাই ছিল আরপা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। আরপা’র অনেক প্রকল্পের একটা ছিল বড় আকৃতির কম্পিউটার নেটওয়ার্ক তৈরি ও এর সম্ভাব্যতা যাচাই।

.

# কার্টারফোন ডিসিশন

একটা সময় পর্যন্ত সব মার্কিন ফোন সাধারণত AT&T কোম্পানির মাধ্যমে লিজ নিতে হত। গ্রাহকরা তখন পর্যন্ত তাদের বাড়িতে বা অফিসে থাকা ফোনগুলির মালিক ছিল না এবং নির্দিষ্ট কিছু কাজ ছাড়া ফোন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা অন্য কোনো কাজের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল।

১৯৬৮ সালে, থমাস কার্টার নামে এক উদ্ভাবক AT&T-এর বিরুদ্ধে মামলা করেন, যা টেলিফোন লাইনের সাথে তৃতীয় পক্ষের ডিভাইস সংযুক্ত করার ওপর AT&T-এর যে একচেটিয়া ছেল সেই নিষেধাজ্ঞার বিলুপ্তি ঘটায়। এই মামলা "কার্টারফোন ডিসিশন" নামে বিখ্যাত।

কার্টারফোন সিদ্ধান্তের ফলে, ডেটা ট্রান্সমিশনের জন্য টেলিফোন লাইন ব্যবহার সম্ভব হয়ে উঠেছিল। এটি ইন্টারনেটের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ ডেটা শেয়ার করার জন্য নতুন আর উন্নত উপায় তৈরির সুযোগ করে দিয়েছিল এই সিদ্ধান্ত।

নতুন নতুন উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সেসময় এই সিদ্ধান্তের ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। 

.

# কম্পিউটার নেটওয়ার্কের প্রথম ব্যবহার


আরপা নেটওয়ার্ক বা ARPANET এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্যাকেট সুইচিং নেটওয়ার্ক এর উন্নয়ন। দ্রুত ডেটা ট্রান্সমিশন সম্ভব করেছিল প্যাকেট সুইচিং নেটওয়ার্ক। 

আরপা’তে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক উন্নয়নের দায়িত্ব ছিল ইঞ্জিনিয়ার লরেন্স রবার্টস এর ওপর। তার সাথে ছিলেন বিজ্ঞানী লিওনার্ড ক্লেইনরক। ক্লেইনরক সফলভাবে প্যাকেট সুইচিং নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে বার্তা পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

তিনি কীভাবে এই অসম্ভব কাজটি সম্ভব করেছিলেন তার জন্য প্যাকেট সুইচিং ব্যাপারটি কী তা বোঝার দরকার। এটি ছোট ছোট ইউনিট বা প্যাকেটে ভাগ করে ডিভাইসগুলিতে ডেটা ট্রান্সমিশনের পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে গন্তব্যে পৌঁছালে ভিন্ন ভিন্ন প্যাকেটে থাকা তথ্যের অংশগুলি একসঙ্গে জড়ো হয়ে পূর্ণ তথ্য তৈরি করে। 

লিওনার্ড ক্লেইনরক ১৯৬৯ সালের ২৯ অক্টোবর টেলিফোন লাইনে অ্যাকুস্টিক ক্যাপলার ব্যবহার করে এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে ডেটা প্রেরণ করেন। 

এই ঘটনাটি ইন্টারনেটের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, কারণ এই প্রথমবারের মত দূরবর্তী দুটি কম্পিউটারের মধ্যে ডেটা সংযোগ স্থাপন সম্ভব হয়েছিল।

তিনি একটা অ্যাকুস্টিক ক্যাপলারসহ টেলিফোন লাইনে মডেম যুক্ত করে দুই কম্পিউটারের মধ্যে ডেটা পাঠিয়েছিলেন। ক্যাপলারে সাদা হ্যান্ডসেট ব্যবহৃত হত, যা স্পিকার ও মাইক্রোফোনযুক্ত একটা ক্র্যাডলে বসানো থাকত।

এই ক্যাপলার মডেম থেকে শব্দ তরঙ্গ বা টোন পাঠাত ও গ্রহণ করত। এতে ডিজিটাল তথ্য বা বাইনারি ডেটা শব্দ সংকেতে রূপান্তরিত হয়ে টেলিফোন লাইন দিয়ে অন্য প্রান্তের ক্যাপলারে গিয়ে পৌঁছাত। সেখানে আবার শব্দ সংকেত ডিজিটাল তথ্যে রূপান্তরিত হত। 

সংযোগের মান ধীরে অনেকটা উন্নত হয়েছিল। ফলে দূরপাল্লার টেলিফোন লাইনের ফিসফাস শব্দের মধ্যেও রিসিভার সঠিক ডেটা গ্রহণ করতে পারত।

ক্লেইনরক লস এঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার একটি কম্পিউটার থেকে স্ট্যানফোর্ড এর আরেকটি কম্পিউটারে বার্তা পাঠান। তিনি LOGIN শব্দটি লিখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ‘L’ এর পরে ‘O’ লেখার সঙ্গে সঙ্গে সিস্টেমটি ক্র্যাশ করে। স্ট্যানফোর্ডের মনিটরে কেবল এই দুইটি বর্ণই তখন দেখা গিয়েছিল।

দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় তিনি দুটি কম্পিউটারের মধ্যে অনেকগুলি বার্তা পাঠাতে সক্ষম হন।

.

# টিসিপি/আইপি’র যাত্রা শুরু

আরপানেট যাত্রা শুরুর পর দ্রুত বাড়তে থাকে। ১৯৭৩ সালের মধ্যে শিক্ষা, সামরিক ও গবেষণা বিষয়ক ৩০টি প্রতিষ্ঠান এই নেটওয়ার্কে যোগ দেয়। নেটওয়ার্কে হাওয়াই, নরওয়ে এবং যুক্তরাজ্যের কিছু প্রতিষ্ঠানও যুক্ত হয়েছিল।

আরপানেট যখন আকারে অনেক বড় হয়ে ওঠে, তখন ডেটা প্যাকেট কীভাবে পরিচালনা করা হবে তার নিয়ম ঠিক করার প্রয়োজন পড়ে। ১৯৭৪ সালে কম্পিউটার বিজ্ঞানী বব কান এবং ভিন্ট সার্ফ তথ্য প্রেরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নতুন প্রটোকল তৈরি করেন, যেটি টিসিপি/আইপি নামে বেশি পরিচিত। 

নেটওয়ার্কের সব কম্পিউটার যেন একই ভাষায় যোগাযোগ করতে পারে সেজন্য এই প্রটোকল খুব জরুরী ছিল। TCP/IP (Transmission Control Protocol/Internet Protocol) হচ্ছে ইন্টারনেটের মূল ভিত্তি, যা বিভিন্ন নেটওয়ার্কের মধ্যে ডেটা আদান-প্রদানের নিয়ম নির্ধারণ করে।

টিসিপি/আইপি’র যাত্রা শুরুর পরে আরপানেট খুব দ্রুত বড় হয়ে একটি বৈশ্বিক আন্তঃসংযুক্ত নেটওয়ার্কসমূহের নেটওয়ার্কে রূপ নেয়। এর মধ্যে ছিল বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোচনার জন্য নিউজগ্রুপ বা USENET, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য তৈরি BITNET নেটওয়ার্ক সহ অন্যান্য নেটওয়ার্ক। নেটওয়ার্কসমূহের এই নেটওয়ার্ককে আমরা ইন্টারনেট নামে চিনি। 

আশির দশকে ARPANET-এর সামরিক অংশ MILNET নামে আলাদা হয়। অবশিষ্ট অংশ 'ইন্টারনেট' নামে পরিচিতি পায়। টিম বার্নার্স-লি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW) তৈরি করেন, যা হাইপারটেক্সট এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করে।

১৯৯০ সালে আরপানেট এর বিলুপ্তি ঘটে।

# ই-মেইল এর সূচনা

আরপানেট বিস্তৃতির বাইপ্রোডাক্ট ছিল ই-মেইল। ইন্টারনেট যত বেশি জনপ্রিয় হতে থাকে এবং এর কাজের পরিধি বাড়তে থাকে, ব্যবহারকারীরা তত বুঝতে পারেন যে আরপানেটে থাকা বিভিন্ন কম্পিউটারের মধ্যে মেসেজ পাঠানোর জন্য এ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা যায়।

মার্কিন কম্পিউটার প্রোগ্রামার রে থমলিনসন প্রথম ব্যক্তি যিনি আমাদের চিরপরিচিত ইলেক্ট্রনিক মেইল বা ই-মেইল এর আইডিয়া দেন। তিনি প্রস্তাব করেন মেসেজের গন্তব্য যেখানে হবে, সেটিকে ‘@’ চিহ্ন দিয়ে প্রকাশ করতে হবে। 

ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত নাম এবং কম্পিউটারের নামের মধ্যে পার্থক্য করার জন্য সর্ব প্রথম ‘@’ ব্যবহার করা হয়। ডিএনএস ব্যবহার যখন শুরু হয়, তখন এটিকে user @ host . domain এই ভাবে ব্যবহার করা হত।

প্রথম দিককার ইমেইল ব্যবহারকারীরা ব্যক্তিগত মেসেজ পাঠাত এবং নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর মেইল লিস্ট তৈরি করত। শুরুর দিকে এমন একটি বড় মেইলিং লিস্ট ছিল SF-LOVERS, এটি ছিল সায়েন্স ফিকশন ভক্তদের একটি মেইল লিস্ট।

ই-মেইল এর অগ্রগতির মাধ্যমে তখন বোঝা যেতে থাকে যে নেটওয়ার্ক কীভাবে বদলে যাচ্ছে। ব্যয়বহুল কম্পিউটারের গণনা শক্তি ব্যবহারের সুযোগ পাওয়ার চেয়ে মানুষের মধ্যে যোগাযোগ, গল্প এবং নতুন বন্ধু তৈরি করার একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে নেটওয়ার্ক।

.

# ইন্টারনেট এর প্রসার, ১৯৮৫-৯৫

ডিএনএস এর উদ্ভাবন, টিসিপি/আইপি’র বহুল ব্যবহার এবং ই-মেইল এর জনপ্রিয়তার ফলে ইন্টারনেটে মানুষের কর্মকাণ্ড রাতারাতি অনেক বেড়ে যায়।

১৯৮৬ থেকে ’৮৭ সালের মধ্যে নেটওয়ার্কে হোস্টসংখ্যা ২ হাজার থেকে ৩০ হাজারে চলে আসে। মানুষ একে অপরের কাছে মেসেজ পাঠাতে, সংবাদ পড়তে এবং ফাইল বিনিময় করতে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করে। 

তবে এই সিস্টেমে ইন্টারনেট চালানোর (ডায়াল-আপ) জন্য এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করার জন্য কিছুটা প্রযুক্তিগত জ্ঞান বা কম্পিউটিং জ্ঞান এর প্রয়োজন হত। আর নেটওয়ার্কে ডকুমেন্টগুলি কীভাবে ফরম্যাট করা হবে সে বিষয়েও তখন পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট ঐকমত্য তৈরি হয়নি।

ইন্টারনেট ব্যবহার মানুষের জন্য আরও সহজ করার প্রয়োজন ছিল। সমস্যাটির সমাধানের একটি সুযোগ আসে যখন ১৯৮৯ সালের মার্চ মাসে টিম বার্নার্স লি নামের এক ব্রিটিশ কম্পিউটার বিজ্ঞানী তার কর্মকর্তার কাছে WWW-এর ধারণা প্রস্তাব করেন।

টিম বার্নার্স লি কাজ করতেন সুইজারল্যান্ডে জেনেভার আন্তর্জাতিক কণা-গবেষণা ল্যাবরেটরি, সার্ন এ। বার্নার্স-লি সার্ন এর কম্পিউটার নেটওয়ার্কে থাকা সকল তথ্য নতুনভাবে সাজানো ও সংযুক্ত করার একটি উপায় প্রস্তাব করেন। এই পদ্ধতিতে নেটওয়ার্কে দ্রুততম সময়ে সহজে তথ্য পাওয়া সম্ভব হবে। তার প্রস্তাবিত ওয়েব অফ ইনফরমেশন বা তথ্যের জাল পরবর্তীতে ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট প্রথম ওয়েবসাইট http : //info . cern . ch সার্নে উন্মুক্ত করা হয়। এবং তার পরে ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব কনসোর্টিয়াম (W3C) প্রতিষ্ঠিত হয়।

টিম বার্নার্স লি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের মূল ধারণা, প্রযুক্তি এবং নীতিমালা তৈরি করেন। তিনি HTTP, HTML, URL -এর মতো WWW-এর ভিত্তি স্থাপনকারী প্রযুক্তি তৈরি করেন। একই সঙ্গে W3C প্রতিষ্ঠা করে WWW-এর উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। টিম বার্নার্স-লির অবদানের জন্য তাকে 'ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের জনক' হিসেবে অভিহিত করা হয়।

১৯৯৫ সালের মধ্যে ইন্টারনেট এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। সেই সময় সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্রাউজার ছিল নেটস্কেপ ন্যাভিগেটর, যার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি।

.

# ওয়েব ব্রাউজার এর সূচনা

টিম বার্নার্স-লি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি এইচটিএমএল ডকুমেন্ট সহজে পড়ার উপযোগী ফরম্যাটে নেওয়ার জন্য সফটওয়্যার তৈরি করেন। তিনি এই ব্রাউজারের নাম দেন ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব’। তবে এই সফটওয়্যার ব্যবহারে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। এটি কেবল অত্যাধুনিক নেক্সট মেশিনে ব্যবহার করা যেত। পরবর্তীতে নিকোলা পেলো নামে বার্নার্স লি’র গণিতের শিক্ষার্থী আরও সহজ একটি ভার্সন তৈরি করেন। সেই ব্রাউজারটি যে কোনো কম্পিউটারে চালানো যেত।

১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ে মার্ক অ্যান্ড্রেসেন নামের আরেকজন মার্কিন শিক্ষার্থী মোজাইক নামের একটি নতুন ব্রাউজার তৈরি করেন। ন্যাশনাল সেন্টার ফর সুপার কম্পিউটিং অ্যাপ্লিকেশনে তৈরি করা এই মোজাইক ব্রাউজার সহজে ডাউনলোড এবং ইন্সটল করা যেত। এই ব্রাউজার বিভিন্ন কম্পিউটারে কাজ করত এবং এর সাহায্যে মাত্র এক ক্লিকের মাধ্যমে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবে অ্যাকসেস পাওয়া যেত।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW) ব্যবহারকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে Mosaic ব্রাউজার। মোজাইক ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ব্যবহারকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ছিল প্রথম ব্রাউজার যা ব্যবহারকারীদের সহজেই ওয়েবসাইটগুলি ব্রাউজ করতে এবং মাল্টিমিডিয়া সমৃদ্ধ সামগ্রী দেখতে সাহায্য করে। 

মোজাইক ছিল প্রথম ব্রাউজার যেটি লেখার পাশেই ছবি দেখাতে পারত। আগের ব্রাউজারগুলিতে ছবি দেখার জন্য আলাদা উইন্ডো খুলতে হত। মোজাইক এর জনপ্রিয়তা ওয়েবের দ্রুত বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছিল এবং আজ আমরা যেভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করি তার ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

মোজাইক ব্যবহার সহজ ছিল বলে প্রচুর মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারে আকৃষ্ট হয়। এই সময় মানুষ আবিষ্কার করা শুরু করে যে কত সহজে তারা নিজেদের একটি এইচটিএমএল ওয়েব পেইজ তৈরি করতে পারে। তাই ১৯৯৩ সালের মাত্র ১৩০টি ওয়েবসাইট থেকে ১৯৯৬ সালে ওয়েবসাইটের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় এক লক্ষে। 

মোজাইক ১৯৯৭ সালে বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু এটি ওয়েব ব্রাউজারের বিকাশে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। আজকের ক্রোম, ফায়ারফক্স, সাফারি এসব জনপ্রিয় ব্রাউজার মোজাইক এর ধারণা ও নকশার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয়েছে।

১৯৯৪ সালে অ্যান্ড্রেসেন এবং উদ্যোক্তা জিম ক্লার্ক মিলে প্রতিষ্ঠা করেন নেটস্কেপ কমিউনিকেশন। তাদের নেতৃত্বে কোম্পানিটি ‘নেটস্কেপ ন্যাভিগেটর’ নামে যে ইন্টারনেট ব্রাউজার তৈরি করেন, সেটি ছিল সে সময়ের অন্য যে কোনো ইন্টারনেট ব্রাউজারের চেয়ে দ্রুত ও আধুনিক। ১৯৯৫ সাল নাগাদ এই ব্রাউজারের ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটিতে।  

.

# ই-কমার্স এর শুরু এবং ‘ডটকম’ বাবল


ইন্টারনেট নিয়ে মানুষের অভূতপূর্ব উৎসাহের কারণে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রযুক্তি খাতে নতুন কোম্পানির শেয়ারের দামে বিশাল উত্থান দেখা দেয়। এই ঘটনাটি ‘ডটকম বাবল’ নামে পরিচিত।

তখন বলা হত, বিশ্বের শিল্প বাণিজ্য একটি ‘নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়’ প্রবেশ করতে যাচ্ছে, যা আগে কখনও দেখা যায়নি। 

মানুষের এই অনুমানের কারণে তখন প্রযুক্তি কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন অস্বাভাবিক রকম বেড়ে যায়। ইন্টারনেটকে তখন মনে করা হত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কেন্দ্রবিন্দু। আর নতুন প্রযুক্তি কোম্পানির শেয়ারের কম মূল্য দেখে ভাবা হত ভবিষ্যতে এই কোম্পানিগুলির বিপুল সম্ভাবনা আছে। ফলে প্রযুক্তি কোম্পানিতে প্রচুর বিনিয়োগ শুরু হয় এবং মানুষের মধ্যে এই কোম্পানিগুলির শেয়ার এর মুনাফা বিষয়ে অবাস্তব প্রত্যাশা তৈরি হতে থাকে।

সেই সময় ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট বা স্বাধীন বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে এবং অনেক কোম্পানি ভুল ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নিয়ে চলতে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিল অনলাইনে বিলাসবহুল ফ্যাশন সামগ্রী বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান Boo ডটকম, এই কোম্পানিটি ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে। কিন্তু ওয়েবসাইট শুরুর মাত্র ৬ মাসের মধ্যে কোম্পানিটির পতন ঘটে।

ব্যর্থ হলেও এই ব্যবসাগুলি একটি মৌলিক পরিবর্তনের ধারা সূচনা করেছিল যা গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত রেখে গেছে। অনেক বিনিয়োগকারী সঞ্চিত অর্থ হারালেও, তাদের মাধ্যমে নতুন এই সিস্টেমে অর্থায়ন বা ফিন্যান্স করার সুযোগ তৈরি হয়। 

আজ সেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই ই-কমার্স ব্যাপকভাবে সফল হয়েছে।


ইন্টারনেট এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

.

# এক নজরে ইন্টারনেটের উন্নয়ন

• ১৯৬০-এর দশক: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের অর্থায়নে ARPANET নামক নেটওয়ার্ক তৈরি

• ১৯৭০-এর দশক: ই-মেইল, টেলনেট, FTP-এর মতো প্রোটোকলের উদ্ভাবন

• ১৯৮০-এর দশক: ARPANET-এর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু, NSFNET নামক নেটওয়ার্ক তৈরি

• ১৯৯০-এর দশক: ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW)-এর উদ্ভাবন, ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি

• ২০০০-এর দশক: সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইল ইন্টারনেটের উত্থান

• বর্তমান: জ্ঞান, বাণিজ্য, যোগাযোগ ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ইন্টারনেট